শামীম-উন-বাছির | শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ | পড়া হয়েছে 942 বার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে অডিট কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর গা ডাকা দেয়া অফিসের “কোটিপতি পিয়ন” ইয়াছিন মিয়া-(৪২) অবশেষে আত্মসমর্পন করেছে। শুক্রবার (০৬ডিসেম্বর ২০১৯) ভোরে সংশ্লিষ্টদের চাপে ইয়াছিন মিয়া সদর মডেল থানার সামনে পৌছলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃত ইয়াছিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর উপজেলার আতুয়াকান্দি গ্রামের মোহন মিয়ার ছেলে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম রেজিষ্ট্রার অফিসের বিভাগীয় পরিদর্শক নৃপেন্দ্র নাথ শিকদার বাদি হয়ে সোনালী ব্যাংকের ভুয়া চালানের মাধ্যমে জালিয়াতি করে ৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইয়াছিন মিয়ার বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
সদর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের একটি সূত্র জানায়, গত ২৬ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম রেজিষ্ট্রার অফিসের বিভাগীয় পরিদর্শক নৃপেন্দ্র নাথ শিকদার অফিসে অডিট কার্যক্রম শুরু করার পর অফিসের কোটি টাকার ঘাপলা রেবিয়ে আসতে থাকে। অডিট কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরই অফিস থেকে গা ডাকা দেন পিয়ন (অফিস সহায়ক) ইয়াছিন মিয়া।
পরে এ ঘটনায় গত ৩০ নভেম্বর সাব রেজিষ্ট্রার মোস্তাফিজ আহমেদ বাদি হয়ে ইয়াছিন মিয়ার বিরুদ্ধে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ (জিডি) করেন।
সদর মডেল থানায় জিডি হওয়ার পর পরই পলাতক ইয়াছিন মিয়ার খোঁজে মাঠে নামে পুলিশ। তার খোঁজে পুলিশ ইয়াছিন মিয়ার তিন স্ত্রীর মধ্যে দুই স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
গত ৩০ নভেম্বর রাতে ইয়াছিনের প্রথম স্ত্রী সাজেদা বেগমকে থানায় ডেকে এনে এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আকলিমা বেগমকে তার শহরের পশ্চিম পাইকপাড়ার বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তৃতীয় স্ত্রী মকসুরা বেগম স্বামী ইয়াছিন মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।
ইয়াছিনের দুই স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পুলিশ তার সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য পায়। তখনই তার বিপুল পরিমান ধন সম্পদের বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের একাধিক কর্মচারী ও দলিল লিখক জানান, সামান্য পিয়নের চাকুরী করেই ইয়াছিন বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরেই রয়েছে ইয়াছিন মিয়ার তিনটি বাড়ি। এছাড়াও তার নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট।
ইয়াছিন মিয়ার প্রথম স্ত্রী সাজেদা বেগম সাংবাদিকদের জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে ইয়াছিন মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর তিনি (ইয়াছিন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সাব- রেজিস্ট্রি অফিসে পিয়ন পদে চাকুরি পান। তিনি জানান, তার স্বামী তাকে (সাজেদা) পৌর এলাকার ভাদুঘর গ্রামে চার শতাংশ জায়গার উপর তিনতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি করে দিয়েছেন। সেই বাড়িতেই তিনি বসবাস করেন। কয়েক মাস আগে তিনি তার বড় ছেলেকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছেন।
সাজেদা বেগম জানান, তাকে বিয়ে করার ১০ বছর পর ইয়াছিন মিয়া আকলিমা বেগম নামে এক বিধবা নারীকে বিয়ে করেন। ওই মহিলার আগের পক্ষের একটি মেয়ে আছে। আকলিমাকে বিয়ে করার পর ওই মেয়েও মায়ের সাথে থাকতো। ওই মেয়ে বড় হওয়ার পর ইয়াছিন তাকে ইতালি প্রবাসী এক যুবকের কাছে তাকে বিয়ে দেন। পরে ইয়াছিন মেয়ের স্বামীর সাথে শহরের পশ্চিম পাইকপাড়া এলাকায় যৌথভাবে একটি ছয়তলা বাড়ি করেন। এছাড়াও পশ্চিম পাইকপাড়ায় ইয়াছিন মিয়া তার ভায়রার সাথে আরেকটি ছয়তলা ভবন নির্মান করেন।
আকলিমাকে বিয়ের পাঁচ বছর পর ইয়াছিন মিয়া এক প্র্রবাসীর স্ত্রী মকসুরা বেগমের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। পরে মকসুরাকেও বিয়ে করেন তিনি। পৌর এলাকার মুন্সেফপাড়ার একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই তৃতীয় স্ত্রী মকসুরাকে নিয়ে বসবাস করেন ইয়াছিন।
গত ২৬ নভেম্বর অফিসে অডিট কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর পরই মকসুরাকে নিয়ে ইয়াছিন গা ডাকা দেন।
সদর সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের একাধিক সূত্র জানান, ইয়াছিন মিয়ার পোস্টিং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। সে দীর্ঘদিন ধরে ডেপুটেশনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত আছেন।
অফিসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান, ইয়াছিন মিয়া জালিয়াতি করে নেয়া টাকা ফেরত দিতে রাজী হওয়ার পরই অফিসের লোকজনের সহায়তায় তাকে পুলিশের কাছে আত্মসম্পর্ন করানো হয়েছে।
একজন পিয়নের চাকুরী করে তিনি কিভাবে ইয়াছিন এতো ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, ইয়াছিন মিয়া সদর সাব- রেজিস্ট্রি অফিসের নকল, তল্লাশী ও রেজিষ্ট্রেশন ফিসহ বিভিন্ন সরকারি ফি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় জমা দিতেন। সোনালী ব্যাংকের চালান জালিয়াতি করে সে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাত করেছেন। এ ঘটনায় আমি সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছি। শুনেছি শুক্রবার সকালে ইয়াছিনকে পুলিশ আটক করেছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন জানান, সকলের সহযোগীতায় ইয়াছিনকে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, ইয়াছিনের বিরুদ্ধে দেয়া চট্টগ্রাম রেজিষ্ট্রার অফিসের বিভাগীয় পরিদর্শক নৃপেন্দ্র নাথ শিকদারের অভিযোগটি আমরা দুদকে পাঠিয়ে দিয়েছি।